atmachitkar

আত্মচিৎকার | তানজিলা তিথি

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। তার সাথে প্রচন্ড বাতাস। বৃষ্টির তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। স্টপেজে বাস থামতেই আমি নেমে পড়লাম। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য দৌঁড়ে ছোট একটা টঙের দোকানে ঢুকে পড়লাম। আশেপাশের সব দোকানই বন্ধ। রাত সাড়ে বারোটা বাজে কোনো দোকান খোলা থাকারও কথা নয়। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে ৮/৯ টার মত বাজে। তখন এখানে মানুষের সমগমে জমজমাট থাকে। আড্ডা হইচই চলতেই থাকে। আমিও বসে দুএক কাপ চা খেয়ে তারপর বাসার দিকে রওনা হই। কিন্তু আজ জিএম স্যারের সাথে ইম্পর্টেন্ট মিটিং থাকায় এত দেরি হলো। চারিদিক নির্জন। বৃষ্টির শব্দে চারিপাশ আরো গাঢ় অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষন পর পর সাই সাই করে দুএকটা গাড়ি ফুল স্পিডে যাচ্ছে। আমি পাশে রাখা বেঞ্চিতে বসে বৃষ্টি কমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠিক তখনই কোট স্যুট পরা এক লোক দৌঁড়ে দোকানের ভিতরে ঢুকলো। তারপর শরীর থেকে ঝেরে বৃষ্টির পানি সরাতে লাগলো। পকেট থেকে রুমাল বের করে মাথাটাও মুছে নিলো।

লোকটির বয়স ত্রিশ পয়ত্রিশ এর বেশি হবে না। গায়ের রঙ ফর্সা। গোলগোল চেহারা। চোখের নিচে কালিপড়া। স্বল্পনিদ্রার মানুষদের এরকম হয়। ভদ্রলোক আমাকে না দেখার ভান করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলেন। বেশ খানিকক্ষন চুপচাপ থাকার পর একসময় ওনার কথায় আমাদের মধ্যাকার নিস্তব্ধতা ভাঙলো।

‘আশেপাশে কোনো পুলিশ ইস্টেশন আছে?’

আমি মুখ ফিরিয়ে তাকালাম ওনার দিকে। তারপর বললাম,

‘আশেপাশে তো নেই। তবে প্রায় দুই মাইল দূরে আছে। কিন্তু এতো রাতে থানায়?

‘একটা জরুরি কাজ আছে।’

‘খুব ব্যক্তিগত না হলে জানতে পারি কী কাজ। না মানে কোনো ধরনের বিপদ নাকি?’

‘আমি একটা খুন করেছি।’

আমি চমকে উঠলাম।

‘খুন!’

atmachitkar
atmachitkar

অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম লোকটার দিকে। কি সহজ সরল মুখ! দেখে মনেই হয় না যে ইনি কারো খুন করতে পারেন। পৃথিবীতে এমন অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু তিনি নিজের অপরাধের কথা আমার কাছে এভাবে বলবেন ই বা কেন? মজা করছে না তো আমার সাথে!’

আমি কৌতুহল দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাকে খুন করেছেন?’

লোকটি নিচু গলায় বললো, ‘একটি মেয়েকে।’

‘কিন্তু কেন খুন করলেন? কিভাবে করলেন?’

এখন তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েছেন বলে মনে হলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলতে লাগলেন,

আমি তখন সবে মাত্র মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। চাকরির জন্য অনেক জায়গায় এপ্লিকেশন করেও কোনো চাকরি পাচ্ছিলাম না। তখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি পড়ানো শুরু করি। ক্লাশ এইটের একটা মেয়ে আমার ছাত্রী ছিলো। নাম ছিলো সিনথিয়া রিদি। পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো। ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল। দেখতেও অত্যন্ত রূপসি ছিলো মেয়েটি। কি মায়া কাড়া চোখ! আমি ধীরে ধীরে ওর প্রতি এক অদ্ভুত মায়া অনুভব করতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম ওকে না দেখে আমি থাকতেই পারছি না। সারাক্ষন ছটফট করতাম। ওর কাছে থাকলেই মনে হয় ভালো থাকি। প্রতিদিন আধা ঘন্টা বেশি পড়ানো। আর পড়ার অজুহাতে খুব গোপনে ছুঁয়ে দেখা এগুলোতেই সুখ খুঁজে পেতাম। কিন্তু ওকে ছোঁয়ার নেশা আমার ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। লোভ হয়ে গেল ওর প্রতি৷ আপত্তিকর স্পর্শগুলো ও ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো। তাই সে তার বাবাকে বলে দিল সব। একদিন তার বাবা আমাকে ডেকে বললেন,

‘আমি চাই না তুমি আর রিদিকে পড়াও। ওর জন্য অন্য টিচার দেখেছি। কাল একবার এসে তোমার বেতনটা নিয়ে যাবে।’

আমি কিছু বলবার আগেই উনি উঠে চলে গেলেন। আমাকে কিছু বলার সময় পর্যন্ত দিলেন না। এদিকে মায়ের কাছে এসে কড়া গলায় নালিশও দিয়ে গেলেন। মা সেদিন কান্নায় ভেঙে পড়লেন। অনেক বকলেন আমাকে। তারপর থেকে লজ্জায় মায়ের সামনে যেতেই পারতাম না আমি। আমার অসম্ভব রাগ হতে লাগলো ওর আর ওর বাবার উপর। ভাবলাম যে কিছু করেই হোক একটা শাস্তি দিতেই হবে ওদের। ঠিক তখনই মাথায় আসলো ওকে মেরে ফেলার কথা। এতে ও নিজেও শাস্তি পাবে আর ওর বাবারও শিক্ষা হবে।

যেদিন টাকা আনতে গেলাম সেদিন রিদিকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। খুঁজতে খুঁজতে ওদের ছাদে গেলাম। দেখলাম রেলিংের পাশে দাঁড়িয়ে জোৎস্না মাখা চাঁদ দেখছে। হাল্কা বাতাসে চুল আর আঁচলটা উড়ছে। কি দারুন লাগছে দেখতে! কিন্তু ওর রূপ আজ আমাকে মুগ্ধ করছে না। আমার মাথায় শুধু একটাই ভাবনা, এই পরীর মত মেয়েটা যদি আমার না হয় আর কারো হতে দিব না আমি। তখনই মাথায় বুদ্ধিটা আসলো। কুবুদ্ধি বলা যেতে পারে। আমি পা টিপে টিপে হেঁটে গিয়ে ওর কাছাকাছি দাড়ালাম। ও টের পেলনা কিছুই। বুঝলাম এই সেই সুবর্ণ সুযোগ! কিছুতেই সুযোগটা হাতছাড়া করা যাবে না। তারপর গায়ের সব জোড় দিয়ে ধাক্কা দিলাম। রিদির দেহটা তখন নিচে পড়ে যাচ্ছিল। একমুহূর্তের জন্য সে ঘুড়ে তাকাল আমার দিকে। সেই মায়াবী চোখে এখন ভয় আর আতংক। যেন হাত বাড়িয়ে বলছে ‘আমাকে বাঁচান স্যার! আমাকে বাঁচতে দিন। এই সুন্দর পৃথিবীতে আমি আরো বেঁচে থাকতে চাই।’ আমি উপর থেকে তাকিয়ে দেখলাম একটা মেয়ের মৃত্যুর শেষ মুহুর্তের আকুতি। এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দে ভরে গেল আমার ভিতরটা। আমি তৃপ্তির হাসি হাসলাম।

আমি ব্যকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর? তারপর কি হলো? মেয়েটি কি মারা গেল?’

‘হ্যাঁ।’

‘বলেন কি! আর আপনি? আপনি কিভাবে পালিয়ে এলেন? আপনাকে কেউ কিছু বললো না?’

‘না।’

‘কেন?’

‘কারন তখন ফেরার সময় ছাদ থেকে পিছলে পড়ে আমিও মারা গেছিলাম।’

আমি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। এটা কেমন কথা! এমন কথার কোনো মানে হয়। এইতো জলজ্যান্ত একটা মানুষ আমার সামনে বসে আছে।মারা গেলে এখানে কিভাবে থাকবে!

‘ঈশ্বর মানুষের কৃতকর্মের অর্ধেক শাস্তি এই দুনিয়াতেই দিয়ে দেন। আর বাকিটা পরকালে।’

লোকটি এই বলে উঠে পড়লো। ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।

আমি পিছন পিছন ছুটে গেলাম। কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারলাম না। ডেকে চললাম অনবরত।

‘এই যে ভাই। এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন? একটু শুনুন। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।’

লোকটি আমার কথায় কান না দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ওনাকে যেন এখন বেশ অচেনা লাগছে। কেমন অদ্ভুত ভাবে হাটছে! দেখলে গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। পরপর দুইটা গাড়ি তার একদম পাশ ঘেষে গেল। তবু সে কিছুটাও বিচলিত হলো না। আমার মনে হলো গাড়িগুলো যেন তার উপর দিয়েই গেল। তারপর একসময় সে আধারে মিলিয়ে গেল।

বৃষ্টি কমে গেছে। আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার। এবার বাড়ি যাওয়ার পালা। তবুও আমি সেখানে বসে রইলাম। কেন জানি আমি লোকটার জন্য অপেক্ষা কর‍তে লাগলাম। যদিও জানতাম সে আর কখনোই ফিরবে না। কোনো দিন ফিরবে না।

Share this article
0
Share
Shareable URL
Prev Post

রক্তাক্ত একুশ | ইমরান হোসেন

Next Post

চাঁদের পাহাড় | বিভূতিভূষণ | বুক রিভিউ | অহর্নিশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Read next
0
Share