১৯৪৫ সালের ৩০ জুলাই,
আনন্দে মেতেছে জাপানি সাবমেরিন আই-৫৮ এর নাবিকরা। শক্তিশালী মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিসকে ডুবিয়ে ক্যাপ্টেন হাশিমোতোর মুখে চওড়া হাসি।
যদিও যুদ্ধের পর হাশিমাতোর এই হাসি চির বিষাদে রূপ নেয়। কারণ মাত্র চারদিন আগে এই জাহাজ ডোবাতে পারলে হাজার হাজার জাপানি নাগরিকের জীবন বেঁচে যেত। কারণ সেই জাহাজ গোপন মিশনে বিশেষ এক কার্গো ডেলিভারি দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। আর ওই কার্গোতে ছিল হিরোশিমার ভয়ানক সেই পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’!
গুটিকয়েক অফিসার ব্যতীত যুদ্ধজাহাজের কেউই জানতো না যে তারা কী বহন করছে। লাখো নিরপরাধ জাপানির মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হওয়া ইন্ডিয়ানাপোলিসের নাবিকরা যেন শিকার হয় ভয়ানক এক অভিশাপের। টর্পেডোর আঘাতে ডুবে যাওয়ার পরবর্তী চারদিন ক্ষুধা-তৃষ্ণা ছাড়াও হাঙরের আক্রমণে একে একে মারা যায় ৫৭৯ জন নাবিক! এটি একক কোনো যুদ্ধজাহাজডুবির ঘটনায় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রাণহানির রেকর্ড।
প্রায় ১৩ হাজার টন ওজনের দানবীয় যুদ্ধজাহাজ ইন্ডিয়ানাপোলিস ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নৌবাহিনীর অন্যতম ভরসা। চারটি ইঞ্জিনের সাহায্যে এটি ঘণ্টায় প্রায় ৬১ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারতো। তবে নয়টি বড় ধরনের কামান সজ্জিত শক্তিশালী এই জাহাজটির একটি বিশেষ দূর্বলতা ছিল। সেটা হলো ইন্ডিয়ানাপোলিস পানির নিচের শত্রু সাবমেরিনের মোকাবেলায় একেবারে অক্ষম ছিল। তাই জাহাজটি এসকর্ট হিসেবে এন্টি সাবমেরিন অস্ত্রে সজ্জিত যুদ্ধজাহাজের প্রহরা নিয়ে চলাচল করতো । কিন্তু ইন্ডিয়ানাপোলিসের মিশন এতটাই গোপনীয় ছিল যে তাকে এসকর্ট যুদ্ধজাহাজ না দিয়েই মিশনে পাঠানো হয়। মূলত জাপানি ইন্টেলিজেন্সের নজর এড়াতে এই ঝুঁকিপূর্ণ মিশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে এসে আবিষ্কৃত হয় পারমাণবিক বোমা। ১৬ জুলাই, ১৯৪৫ সালে প্রজেক্ট ম্যানহাটনের প্রথম বোমার পরীক্ষা ‘ট্রিনিটি টেস্ট’ সংগঠিত হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পরই ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিস পরিশোধিত ইউরেনিয়াম-২৩৫ ও লিটল বয় বোমার প্রয়োজনীয় পার্টস নিয়ে রওনা দেয়।
তার গন্তব্য ছিল ফিলিপাইনের তিনিয়ান আইল্যান্ড। ২৬ জুলাই সেখানে পারমাণবিক বোমার পার্টস ও ইউরেনিয়াম-২৩৫ পৌঁছে দিয়ে গুয়াম দ্বীপের মার্কিন ঘাঁটিতে নোঙর করে ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিস। এরপর ২৮ জুলাই এটি রওনা দিল জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে।
জাহাজটি তার গতিপথে কমপ্লিট রেডিও সাইলেন্স বজায় রাখে যাতে জাপানিদের রেডিওতে ইন্ডিয়ানাপোলিসের উপস্থিতির কথা কোনোভাবেই ধরা না পড়ে। এমনকি কার্গো ডেলিভারির পরেও রেডিও সাইলেন্স বজায় রাখা হয়। যাতে জাপানিদের মনে সামান্যতম সন্দেহ না জাগে ইন্ডিয়ানাপলিসের মিশন সম্পর্কে।
কিন্তু হঠাৎ বিপদ দেখা দিয়।জাপানি সাবমেরিন আই-৫৮ এর সোনারে ধরা পড়ে যায় ইন্ডিয়ানাপোলিস। কয়েক ঘন্টা ধরে ইন্ডিয়ানাপোলিসকে অনুসরণ করার পর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয় জাপানি সাবমেরিনটি। ৩০ জুলাই গভীর রাতে ২টি টর্পেডো ফায়ার করা হয়। ইন্ডিয়ানাপোলিস সেগুলোকে ফাঁকি দেয়ার কোন সুযোগই পায়নি। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে আগুন ধরে যায় জাহাজের গোলাবারুদের গোডাউনে। আগুন নেভানো অসম্ভব ভেবে ক্যাপ্টেন জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। আক্রান্ত হওয়ার বারো মিনিটের মাথায় বিশাল জাহাজটি সম্পূর্ণ উল্টে যায়! আক্রান্ত হওয়ার মুহূর্তে জাহাজে প্রায় হাজার খানিক নাবিক ছিল।
ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিসে পর্যাপ্ত সংখ্যক লাইফবোট ও লাইফ জ্যাকেট ছিল না। খাদ্য, জরুরি ওষুধ, রেডিও, সিগন্যাল লাইট এগুলো তেমন কিছুই জাহাজ থেকে সংগ্রহ করা যায়নি। এমনকি রেডিও যোগাযোগ না হওয়ায় হেডকোয়ার্টারও ইন্ডিয়ানাপোলিস ডুবে যাওয়ার খবর পায়নি।চারদিন খোলা সাগরে ভাসতে ভাসতে নাবিকরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েন। মাথার উপরে তপ্ত সূর্য, নিচে খাওয়ার অনুপযোগী লবণাক্ত পানি। সল্ট ওয়াটার পয়জনিং, হ্যালুসিনেশনের পাশাপাশি দিনের বেলা গরমে ডিহাইড্রেশন, রাতের ঠান্ডায় আবার হাইপোথার্মিয়াতে আক্রান্ত হন নাবিকরা কিন্তু বিধি বাম, ক্ষুধা-পিপাসার চেয়েও বড় শত্রু হাজির হয়ে যায়। আহত নাবিকদের রক্তের গন্ধ দলে দলে টেনে আনে সাগরের বিভীষিকা হাঙরের পালকে। সাঁতরে পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে টাইগার ও হোয়াইটটিপ শার্কের খাবারে পরিণত হয় বহু নাবিক। এজন্য ইউএসএস ইন্ডিয়ানাপোলিসের ঘটনাকে Worst Shark Attack of Maritime History হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ক্ষুধা-পিপাসা সহ্য করতে না পেরে অনেকেই মারা যান, কেউ কেউ আত্মহত্যা করেন, কেউ বা আবার জ্ঞান হারিয়ে ডুবে মারা যান।
জাহাজডুবির তিনদিন পর আমেরিকার এক টহল বিমানের পাইলট রুটিন টহলের সময় সমূদ্রে লড়াইরত নাবিকদের দেখতে পান। সাথে সাথে তিনি খবর দেন হেডকোয়ার্টারে। প্রথমে একটি উভচর বিমান ও পরে আরেকটি জাহাজ এসে বেচে থাকা নাবিকদের উদ্ধার করে।
সব মিলিয়ে ৩১৬ জনকে উদ্ধার করা হয়। অন্তত ১৫০ জন হাঙরের কামড়ে মারা যায়। এই ঘটনায় মোট ৫৭৯ জন মারা যায় যা আজ পর্যন্ত কোন নৌযুদ্ধে সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা।
নাবিকদের কাছে এই স্মৃতি এতটাই ভয়ানক ছিল যে তাদের প্রায় কেউই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। অনেকেই বাকিজীবন কাটাতে হয়েছে স্থায়ী মানসিক সমস্যা নিয়ে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমুল হয়ে যায় যে হিরোশিমায় নিহত মানুষদের নিরব অভিশাপের কারণেই সেই জাহাজের নাবিকদের পৃথিবীতেই নরকের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
পরিশেষে বলা যায় নিছক দূর্ঘটনা বা যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা থাকে। যার অন্যতম উদাহরণ ইন্ডিয়ানাপোলিসের হতভাগ্য নাবিকেরা।